শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বেশির ভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার (সদস্য) গা-ঢাকা দিয়েছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান-মেম্বাররা বর্তমানে পলাতক।
দুই মাস ধরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেখানকার সেবাপ্রার্থী মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জনসাধারণের কষ্ট লাঘবে সিটি করপোরেশন-পৌরসভা, জেলা-উপজেলা পরিষদের মতো ইউনিয়ন পরিষদেও ‘প্রশাসক’ নিয়োগের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার।
এ কারণে দেশের পাঁচ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়নের মধ্যে কতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার বর্তমানে অনুপস্থিত আছেন তার তথ্য চেয়ে গত ৬ অক্টোবর জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সূত্র জানায়, এই স্তরের জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতির হার বেশি হলে সিটি করপোরেশন-পৌরসভা, জেলা-উপজেলা পরিষদের মতো বিদ্যমান আইনে নতুন ধারা যুক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করা হবে। এরপর অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে ইউনিয়ন পরিষদেও প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। আর জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতির হার কম হলে প্রশাসক নিয়োগ না করে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনয়িন পরিষদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই দুই ধরনের প্রস্তুতিই রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের।
প্রসঙ্গটি সম্পর্কে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমি এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধিরা নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও গা-ঢাকা দিয়েছেন। যেখানে ১০-১২ জন থাকার কথা, সেখানে হয়তো দুই-তিনজন আছেন।
আমরা তো তাঁদের নিষেধ করিনি! এর ফলে জনগণ সেবাবঞ্চিত হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধির নামে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, রাজনৈতিক খুন-হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে মামলা দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
কারণ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এসব জনপ্রতিনিধি দ্রুত নিজ এলাকায় ফিরতে পারবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। এতে প্রতিদিনই স্থানীয় সরকার বিভাগে জনসেবা ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ আসছে।
এ কারণে গত ১৮ আগস্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর এবং জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে এসংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর রাজধানীসহ বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরগুলোয় সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর এবং জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের অপসারণ করে সেখানে ‘প্রশাসক’ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে সেখানকার সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি ও ভোগান্তি অনেকাংশে কমেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদে কোনো প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অথচ সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা এ স্তরেই বেশি। স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদকে সরকার আলাদাভাবে দেখে থাকে। কারণ সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার কাজের ধরনের চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের কাজের ধরন কিছুটা ভিন্ন।
সরকারের ত্রাণ বিতরণ থেকে তৃণমূলের যেকোনো ধরনের কাজে ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। গ্রাম পর্যায়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রভাব অনেক বেশি। শেখা হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এরপর গত ১৮ আগস্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন-পৌরসভা, জেলা-উপজেলা পরিষদে প্রশাসক বসানোর বিধান রেখে এসংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়ায় অনুমোদন দেয় সরকার।
তাতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অধিক্ষেত্রে জনগণের নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিতকরণ, প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখা ও জরুরি কারণে অধ্যাদেশের অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এ দুটি নতুন ধারা ১৩(ক) ও ২৫(ক); স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪—এ দুটি নতুন ধারা ৩২(ক) ও ৪২(ক); জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এ দুটি নতুন ধারা ১০(খ) ও ৮২(ক); উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এ দুটি নতুন ধারা ১৩(ঘ) ও ১৩(ঙ) যুক্ত করা হয়েছে।