৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ঘিরে সমন্বয়কদের কি কি পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনায় ব্যর্থ হলে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতো। এমনকি সবাইকে মেরে ফেললে আন্দোলন চলমান রাখতে প্ল্যান-ই বা কী ছিল? এসব বিষয় নিয়ে ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রিফাত রশিদ।
শনিবার (৩০ নভেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন তিনি।
ফেসবুকে রিফাত রশিদ লিখেছেন, যারা ভাবেন ছাত্ররাই দেশ চালায় তারা ভুল ভাবেন। ছাত্ররা গোটা ক্ষমতাকাঠামোর একটা অংশ, পুরোটা জুড়ে মোটেও ছাত্ররা নাই। সরকারে ছাত্র প্রতিনিধিদের বার্গেইন করতে হয়। সরকারের বাইরে যারা সেই ছাত্রদের ভরসা আসলে রাজপথ, তাদের ভরসা শিক্ষার্থীরা, তাদের ভরসা জনগণ। এই বাদে তাদের কোনো ভরসার জায়গা নাই।
কালবেলার পাঠকদের জন্য রিফাত রশিদের স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো :
‘৫ ই আগস্ট “৩৬ জুলাই” এর গল্প (লেখাটা একটি দীর্ঘ হবে বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)।
৫ই আগস্টে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আমাদের পরিকল্পনা ছিলো শহীদ মিনার বা শাহাবাগ দুইটার যেকোনো একটা জায়গায় আমরা জড়ো হবো, সেখান থেকে আমরা গণভবন অভিমুখী মার্চ করবো। যদি গণভবনের দিকে মার্চ করার সময় আমাদের উপর ম্যাসাকার চালায় তাহলে আমরা ‘সশস্ত্র সংগ্রামের’ দিকে যাবো। নাহিদ ভাই সশস্ত্র সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে একটা ভিডিওবার্তাও বানিয়ে রাখে, দুই একজন জার্নালিস্টকে এই ভিডিওবার্তা পাঠিয়ে রাখে যদি আমরা কেউই পরবর্তীতে ঘোষণা দেয়ার জন্য বেচে না থাকি তাহলে ৫ তারিখের পর যাতে আন্দোলন নির্দেশনার অভাবে নিস্তেজ না হয়ে যায়। আমরা যারা নেতৃত্ব দিয়েছি তারা সহ গোটা দেশই শহীদ হওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম।
সকাল থেকে ঢাকার পরিবেশ ছিলো থমথমে, সকালেই শহীদ মিনারে গুলি চলে। আসিফ-বাকের-মোয়াজ্জেম ভাইকে হত্যার জন্য চানখারপুলে বার্ন ইউনিটের উপর থেকে স্নাইপার দিয়ে গুলি চালায়। কিন্তু একটা পর্যায়ে মোটামুটি অর্গানিকভাবেই (ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্পট ও প্রবেশমুখগুলোতে আমাদের প্রতিনিধিদের সাথে কানেকশন ছিলো আমাদের) গণভবন অভিমুখে মার্চ করে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে ঢাকার রাস্তায়।
শাহাবাগে আমরা যখন ছিলাম তখন বিভিন্ন সোর্স থেকে নিউজ আসতে থাকে, ‘হাসিনা পদত্যাগ করে ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কাছে হ্যান্ডওভার করবে।’ আসিফ ভাই শাহাবাগ থেকে ভিডিওবার্তা দেয় যে, সেনাশাসন এদেশের জনগণ মানবে না। আমিও ভিডিওবার্তা দেই এই টপিকে, পোস্ট করি যে ‘দেশের ভবিষ্যৎ ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, নির্ধারিত হবে অভ্যুত্থানের মঞ্চ শাহবাগ থেকে।’ সারাদেশের মানুষ আমাদের সর্বাত্মক সমর্থন জানায়, ফলে সেনাশাসনের সম্ভাবনা সেখানেই নস্যাৎ হয়ে যায়।
এরপর শাহাবাগ থেকে গণভবন অভিমুখে লংমার্চ শুরু হয়। তখনও আমরা জানতাম না যে, ‘হাসিনা আদৌ পালাইছে কিনা। লংমার্চ যখন মোটামুটি ফার্মগেটের কাছে তখন আমরা জানতে পারি হাসিনা দেশছেড়ে পালাইছে। তখন গণভবন অভিমুখী লংমার্চ বিজয় মিছিলে রূপ নেয়।
এতোক্ষণ জানা ঘটনাগুলো আওড়ালাম কারণ পুরো ঘটনাপ্রবাহ যারা জানে না তাদের বোঝা সহজ হবে। আমরা মার্চ শেষে দ্রুত শাহাবাগে আসার প্ল্যান করি। শাহাবাগ থেকে আমরা ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ কিভাবে পরিচালিত হবে সেটা নির্ধারণ করবো। কিন্তু হিসেব এতোটাও সহজ ছিলো না।
দুপুর থেকেই আসিফ নজরুল স্যার নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই ও মাহফুজ ভাইকে খুঁজছিলেন বঙ্গভবনে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা যারা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে এক্টিভিজম করেছি তাদের মাঝে প্রাথমিক বোঝাপড়া থাকার জন্য আমরা সকলেই জানতাম আমরা বঙ্গভবনে যাবো না।আমাদের ডিসিশন শাহাবাগে জনতার মঞ্চ থেকেই হবে। নাহিদ আসিফ মাহফুজ ভাইয়েরা এই সিদ্ধান্তে একমত ছিলেন। কিন্তু ওই মুহূর্তে সবাই একসাথে বসে একটা একক সিদ্ধান্ত নিতে পারবো এই সুযোগ আমরা পাই নাই।
আসিফ নজরুল স্যার নাহিদ-আসিফ-মাহফুজ ভাইদের রাজি করাতে না পেরে হাসনাত ভাইকে এপ্রোচ করেন। আপনারা যারা আমাদের লংমার্চের ভিডিও দেখেছেন তারা জানেন নাহিদ-আসিফ ভাই এক রিক্সায় ছিলেন, সারজিদ-হাসনাত ভাই অন্য আরেকটা রিক্সায় ছিলেন। ফলে নাহিদ-আসিফ-মাহফুজ ভাইয়েরা বঙ্গভবনে যাবেন না এই সিদ্ধান্তটা হাসনাত ভাইয়েরা জানতেন না।