কাঁদতে কাঁদতে শিক্ষা উপদেষ্টার পা জড়িয়ে ধরলেন এমপিওভুক্ত বেসরকারি দুই শিক্ষক! তাদের চাওয়া- শূন্য পদে বদলির সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন। বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সচিবালয়ে ঘটা এই ঘটনার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের একটি দল শূন্যপদের বিপরীতে বদলির দাবীতে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে দেখা করতে যান। এক পর্যায়ে দুজন শিক্ষক শিক্ষা উপদেষ্টার পায়ে পড়ে কান্না শুরু করেন। এসময় শিক্ষা উপদেষ্টা ওই দুই শিক্ষককে তোলার চেষ্টা করেন-এমন ছবি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে।
শিক্ষা উপদেষ্টার পা জড়িয়ে ধরা শিক্ষকরা হলেন ‘এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশী ঐক্য পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো সাকিবুল ইসলাম ও রাজশাহী জেলার সমন্বয়ক শরিফুল ইসলাম।
মো সাকিবুল ইসলামের বাড়ি রাজশাহীতে। তিনি চাকরি করেন চাঁদপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে। শনিবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। আমি এটা ইচ্ছাকৃত করিনি। আবেগের বশবর্তী হয়ে করে ফেলেছি। কারণ, গত ৭ তারিখে আমার দাদি শাশুড়ি মারা গেছে কিন্তু আমি সেখানে যেতে পারিনি। কারণ, আমি চাঁদপুরে কর্মরত। মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি সকাল ৮টায় আর দাফন হয়েছে দুপুর আড়াইটায়। আমার পক্ষে ওই সময়ের মধ্যে রাজশাহীতে যাওয়া সম্ভব ছিলো না।’
তিনি বলেন, আমার আত্মীয়-স্বজন মারা গেলেও আমি দেখতে যেতে পারি না। আমার মতো অসংখ্য শিক্ষক আছে যাদের জীবন দুর্বিষহ।
উপদেষ্টার পা জড়িয়ে ধরার সময়ের বর্ণনা দিয়ে মো সাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমি ওটা করে ফেললে উপদেষ্টা মহোদয় বলেন, ‘ওঠো ওঠো বাবা, তোমাদের কাজ তো করে দিয়েছি, তোমাদের কাজ তো হচ্ছে’।’’
তিনি জানান, ওই ঘটনার পর শিক্ষা উপদেষ্টা নিজের ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে ওই শিক্ষকদের পাঠিয়ে দেন বিস্তারিত কথা বলার জন্য। সেখানে কর্মকর্তারা শিক্ষকদের আশ্বস্ত করেন যে, তাদের কাজ দ্রুত হয়ে যাবে।
জানা গেছে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে অনেক নিবন্ধনধারী শিক্ষক নিজ এলাকায় শূন্যপদ না থাকায় দেশের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় আবেদন করে সুপারিশ পেয়েছেন। ২০১৫ সালের পরিপত্রের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ সাময়িক স্থগিত করার কারণে চতুর্থ ও পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারীদেরও আবেদনের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে লক্ষাধিক ইনডেক্সধারী শিক্ষক ভোগান্তিতে পড়েন। তারপর থেকেই শিক্ষকরা নানা সময়ে বদলির দাবীতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে এলেও তাদের এ সমস্যার সমাধান হয়নি। শিক্ষকদের দাবীর মুখে কয়েকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পারস্পরিক বদলির প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। এরইমধ্যে শিক্ষকদের পারস্পরিক বদলির আবেদন শুরু হয়েছে যা চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু শিক্ষকরা মনে করছেন, এতে ১% শিক্ষকও উপকৃত হবেন না।
বদলি প্রত্যাশিত শিক্ষকরা জানান, স্বল্প বেতনে নিজ পরিবার ছেড়ে শতশত কিলোমিটার দূরে দায়িত্ব পালন করা ভীষণ কষ্টকর। বিশেষ করে পরিবার পরিজন ফেলে নারী শিক্ষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সংসার ভাঙার উপক্রম পর্যন্ত হচ্ছে। না পারছে স্বামী-সংসার ঠিক রাখতে, না পারছে চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরে রাখতে।
বদলি প্রত্যাশিত শিক্ষক সোলায়মান মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায়। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে আমার চাকরি হয় টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায়। স্বল্প বেতন বাড়ি ছেড়ে একশত কিলোমিটার দূরে কোনোভাবেই আর চাকরি করতে পারছি না। শ্রেণি কক্ষে পাঠদান শুরুর আগে যখন আমার সন্তান ফোন দিয়ে বলে আব্বু তুমি কোথায়? তখন আমি কোনোভাবেই শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিতে পারি না। বাড়িতে থাকলে সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে স্কুলে যেতে পারতাম। বাবা নেই, মা অসুস্থ হলেও সময়মত হাসপাতালে নিতে পারি না। অথচ আমাদের বদলি করে নিজ উপজেলায় দিলে সরকারের একটি টাকাও অতিরিক্ত ব্যয় হবে না। আমরা শিক্ষকরাও আগামির প্রজন্মকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শতভাগ মনোনিবেশ করতে পরতাম। তবুও অদৃশ্য এক কারণে আমাদের বদলি হচ্ছে না।’
এদিকে আরও কয়েকজন শিক্ষক জানান, গত কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে শূন্য পদের বিপরীতে বদলির বিষয়টিতে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সম্মতি রয়েছে-এমনকি তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু প্রজ্ঞাপন হচ্ছে না। এতে করে বদলি প্রত্যাশিত লাখো শিক্ষক উদ্বিগ্ন-উৎকন্ঠায় দিন পার করছে।
‘এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশী ঐক্য পরিষদ’ এর সভাপতি মোঃ সরোয়ার বলেন, আমরা মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি করি। এত কম টাকায় দূর দূরান্তে চাকরি করতে গিয়ে অমানবিক কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে আমাদের।
তিনি বলেন, ‘এটা কিন্তু বাজেটবিহীন বদলি। এখানে সরকারের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই। মন্ত্রণালয় আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন দিচ্ছে না। আমরা চাই প্রজ্ঞাপন দিয়ে দ্রুত বদলি হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হোক।’