বিচারপতি মানিককে নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার লোমহর্ষক তথ্য

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আনসার উদ্দিন খান পাঠান। তিনি ২০২৪ সালের ২৪ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেও সম্প্রতি এটি ভাইরাল হয়েছে।

ফেসবুকে স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন- ব্যস্ততম সড়কে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের গাড়ি লক্ষ্য করে স্যালুট না দেওয়ায় এজলাসে ডেকে সার্জেন্টদের শাস্তি দেন।

২০০৩ সন। আমি তখন ডিএমপির (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ) ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক -নর্থ। পুরো ঢাকায় তখন মাত্র দুজন ডিসি ট্রাফিক ছিলেন, নর্থ আর সাউথ। ফার্মগেট পড়েছিল উত্তর ডিভিশনের কর্ম এলাকায়। আমার অভ্যাস ছিল সকাল ৭টায় রমনা পুলিশ কমপ্লেক্সের সরকারি বাসা থেকে বেরিয়ে পুরো উত্তর ঢাকার প্রধান প্রধান রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের ডিউটি তদারকি করে মোহাম্মদপুরস্থ অফিসে ঢোকা এবং দিনের দাপ্তরিক কাজ শুরু করা।

সেদিন সবেমাত্র অত্যন্ত ব্যস্ত ট্রাফিক ক্রসিং ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ ধরে অফিসে এসে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মগেট থেকে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ওবায়েদ ফোন করে জানান, একজন বিচারপতি তাকে এবং সেখানকার ৩ পুলিশ সার্জেন্টকে হাইকোর্টের ফ্ল্যাগওয়ালা গাড়ির কাছে ডেকে উচ্চস্বরে বকাঝকা করছেন এবং বলছেন, তিনি রাস্তাতেই ক্ষমতাবলে কোর্ট বসাচ্ছেন এবং তাদের সাজা দিবেন। কী অপরাধ? সার্জেন্টদের কেউ তার গাড়ি লক্ষ্য করে স্যালুট করেনি। ওবায়েদ সাহেব আমাকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। আমি রওনা হলাম।

অফিস শুরুর সময়, রাস্তায় বেশ জ্যাম। ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখি বিচারপতি চলে গেছেন। ঘটনা শুনলাম সবিস্তারে।

বিচারপতি মানিক (যাবার সময় তার ড্রাইভার পরিচয় বলে যায়) ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে ফার্মগেট হয়ে হাইকোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। তিন সার্জেন্ট গলদঘর্ম হয়ে ট্রাফিকের পিক আওয়ারে দাঁড়িয়ে সিগন্যাল দিচ্ছিলেন সেখানে। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে কালো রঙের ছোট্ট ফ্ল্যাগ লাগানো গাড়িটি তারা কেউ লক্ষ করেনি, স্যালুট করেনি। বিচারপতি তার গাড়িটি হলিক্রস কলেজের গেটের কাছে নিয়ে থামালেন। ড্রাইভারকে দিয়ে কর্মরত সার্জেন্টকে ডাকলেন। সার্জেন্ট গাড়ির কাছে আসার পর রাগতস্বরে জানতে চাইলেন, তাকে স্যালুট করা হয়নি কেন। সার্জেন্ট হতভম্ব, ব্যস্ত রাস্তায় এমন প্রশ্ন কেউ কখনও করেনি। তবু মাপ চাইলেন। বিচারপতি আরও খেপে গেলেন। তিনি এখানে যারা ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের কাজ করছেন সবাইকে তার গাড়ির কাছে ডেকে আনতে বললেন। যথারীতি ইন্সপেক্টর ওবায়েদের নেতৃত্বে ৩ সার্জেন্ট এসে হাজির হলেন।

ওদিকে পুরো ক্রসিং এ অস্বাভাবিক ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হলো। তিনি তোয়াক্কা করলেন না। পুলিশ কেন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জানে না, কেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পুলিশ একাডেমির ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় না, কেন পুলিশ চোখকান খোলা রাখেনি, এসব নিয়ে অস্বাভিক রেগে গিয়ে বকাঝকা করলেন তিনি। বারবার ক্ষমা চাওয়াতেও তিনি ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বললেন, হলিক্রসের সামনের রাস্তাতেই তিনি কোর্ট হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন এবং এখানেই তিনি অফিসারদের শাস্তি দেবেন।

তারপর তিনি অফিসারদের নামধাম লিখে নেন, ডিসি ট্রাফিক হিসেবে এই অধমের নামটিও নিয়ে যান। সেদিন বিকেলেই ফার্মগেট পুলিশ বক্সে সমন এলো, তিন সার্জেন্ট এবং ইন্সপেক্টর যেন পরদিন হাইকোর্টে বিচারপতির মানিকের এজলাসে হাজির হন। সকালে যথারীতি অফিসাররা হাইকোর্টে হাজির হন। তাদের দেখে হাইকোর্টে সাংবাদিক এবং অ্যাডভোকেট সাহেবদের ভিড় লেগে যায়। সবাই উৎসুক, ঘটনা জানার জন্য। অ্যাডভোকেট মামুন নামের একজন বিনা পারিশ্রমিকে পুলিশের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি এজলাসে পুলিশের পক্ষে লড়েন। শেষ পর্যন্ত বিচারপতি মানিক ৩ সার্জেন্ট প্রত্যেককে ২০০ টাকা করে জরিমানা করেন অনাদায়ে ৩ মাসের জেল দেন। ইন্সপেক্টর ওবায়েদকে বন্ড দিতে বলা হয়, এমন অপরাধ আর তিনি করবেন না মর্মে। তারা জরিমানা ও বন্ড দিয়ে মুক্তি পান।